মলদোভা, পূর্ব ইউরোপের একটি ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ দেশ, এক সময় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। তবে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মলদোভা বহু রাজনৈতিক উত্তালতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আজকের মলদোভা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে রয়েছে, এবং ২০২৪ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অন্তর্ভুক্তির আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রো-ইইউ ও প্রো-রাশিয়ান দলগুলোর টানাপোড়েন ক্রমাগত গভীর হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, মলদোভার রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখা যায়। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবিধান সংশোধন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, এবং ইউরোপীয় সমন্বয়মূলক সংস্থা গুলোর সাথে চুক্তি মলদোভার রাজনৈতিক মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এই প্রবন্ধে, আমরা মলদোভার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা, প্রধান দল ও নেতৃবৃন্দ, এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অভিমুখ বিশ্লেষণ করব।
সোভিয়েত ছায়া: মলদোভার স্বাধীনতা লাভ ও প্রাথমিক রাজনৈতিক কাঠামো
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, মলদোভা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতা লাভের পরপরই, দেশের প্রথম রাজনৈতিক কাঠামো নির্মিত হয় যা মূলত সোভিয়েত ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল। প্রথম প্রেসিডেন্ট মিরচা স্নেগুর একটি আধা-প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থাপনার ভিত্তি স্থাপন করেন, যেখানে নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মধ্যে বিভক্ত ছিল। এই পর্যায়ে, রাজনৈতিক দলগুলো গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। তবে, সোভিয়েত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত بيرোক্রেটিক কাঠামো এবং দুর্বল অর্থনীতি রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
দেশটির প্রথম সংবিধান ১৯৯৪ সালে গৃহীত হয়, যেখানে গণতন্ত্র, আইনসঙ্গতা এবং মানবাধিকার রক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে, তখনকার শাসনব্যবস্থা ছিল একপক্ষীয় এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার প্রবণতা ছিল প্রবল। ফলে, স্বাধীনতার প্রথম দশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মলদোভার এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কমিউনিস্ট শাসনের পুনরাবৃত্তি ও জাতীয় পরিচয় সংকট
২০০১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন মলদোভার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী অধ্যায় ছিল। ভ্লাদিমির ভোরনিনের নেতৃত্বে, মলদোভার কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং দেশটিকে পূর্বমুখী নীতির দিকে ধাবিত করে। এই সময়ে রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
তবে, এই সময়কালেও জাতীয় পরিচয় সংকট প্রবল ছিল। একদিকে ছিল রোমানিয়ান-ঘেঁষা জাতীয়তাবাদী দলগুলো, যারা মলদোভাকে রোমানিয়ার অংশ হিসেবে দেখত। অন্যদিকে, ছিল রাশিয়াপন্থী গোষ্ঠী যারা মলদোভার স্বতন্ত্র পরিচয়কে রক্ষা করতে চেয়েছিল। এই মতবিরোধ রাজনীতিতে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে নানা সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দেয়।
ইউরোপীয় আকাঙ্ক্ষা: নয়া রাজনৈতিক দল ও সংস্কার আন্দোলন
২০১০ সালের পর মলদোভায় একটি নতুন রাজনৈতিক পর্বের সূচনা হয়। ইউরোপীয় সংহতি ও মূল্যবোধকে ভিত্তি করে গঠিত হয় ‘লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’, ‘অ্যাকশন অ্যান্ড সলিডারিটি পার্টি’ (PAS) সহ একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল। এই দলগুলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং ইইউ-ভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে থাকে।
বিশেষ করে ২০১৫ সালের ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির পর, নাগরিক সমাজ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়। এই সময় ‘প্লাটফর্ম ফর ডিগনিটি অ্যান্ড ট্রুথ’ নামে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে যা পরে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়। মলদোভায় এই নতুন গণতান্ত্রিক চেতনা ধীরে ধীরে নির্বাচন ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে থাকে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের বিস্তারিত
PAS এর উত্থান এবং মাইয়া সান্দুর নেতৃত্বে পরিবর্তন
২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাইয়া সান্দু’র বিজয় মলদোভার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সূচনা করে। তিনি PAS-এর নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান নেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর শাসনামলে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।
PAS পার্টি ২০২১ সালের সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যার ফলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের শক্তিশালী ম্যান্ডেট অর্জিত হয়। এই সময় মলদোভা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একটি নিরাপত্তাজনিত সংকটের মুখোমুখি হয়, তবে সান্দু প্রশাসন ইউরোপমুখী অবস্থানে দৃঢ়তা বজায় রাখে।
ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মলদোভার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে গভীর প্রভাব ফেলে। দেশটি রাশিয়ার শক্তির উপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপীয় জ্বালানি বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। একই সাথে, ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মলদোভা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়। তবে, এই যুদ্ধ মলদোভায় নতুন করে রাশিয়াপন্থী আন্দোলনের উত্থান ঘটায়, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
এই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, মলদোভা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইউরোপীয় কমিশন মলদোভার অর্থনৈতিক সংস্কার এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নানা পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
ভবিষ্যতের পথে: সংহতি না বিভাজন?
বর্তমানে মলদোভা একটি ক্রান্তিকালে রয়েছে। একদিকে, PAS এবং ইউরোপমুখী গোষ্ঠীগুলো দেশে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, অন্যদিকে রাশিয়াপন্থী গোষ্ঠীগুলো জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিচয় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে। এই দ্বন্দ্ব মলদোভার ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করবে।
আগামী কয়েক বছর, বিশেষ করে ২০২৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আলোচনার গতিপথ, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মলদোভা ইউরোপীয় আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার বজায় রাখতে পারে, তবে দেশটি একটি স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী পথে অগ্রসর হতে পারবে।
ইইউ সংযুক্তি সম্পর্কে আরও পড়ুন
*Capturing unauthorized images is prohibited*